মসলার যুদ্ধের কাহিনী

৮ জুলাই, ১৪৯৭। পর্তুগালের ট্যাগাস নদীর মুখে বেলেম পোতাশ্রয় থেকে ৪টি জাহাজ ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করলো। ভাস্কো দ্য গামা ছিলেন এই অভিযানের অধিনায়ক। ১৪৯৮ সালের ২০ মে কামানে সুসজ্জিত এই পর্তুগিজ বহর এসে পৌঁছাল কালিকটের ঘাটে।

ভারতবর্ষের দক্ষিণতম প্রান্তে মালাবার বা কেরল আর তার পূর্বদিকে বিজয়নগর – এ দুয়ের মাঝে দুর্ভেদ্য পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার আড়ালে ছিল ছোট ছোট কতগুলো স্বাধীন রাজ্য, যাদের মধ্যে প্রধান হচ্ছে কালিকট – সেই সময়কার মসলার বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। মালাবার, মালয়, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে উৎপাদিত গোলমরিচ, এলাচি কালিকট বন্দর থেকেই ইউরোপের দেশগুলোতে চালান করা হত। মসলার বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধির শিখরে ওঠা কালিকট বন্দরের খ্যাতি ছিলো বিশ্বজুড়ে। বিভিন্ন দেশের বণিকরা এখানে শান্তি-সম্প্রীতির সাথে বাণিজ্য করতো। তাই এই বন্দরে যখন পর্তুগিজদের কামানসজ্জিত, মজবুত গঠন আর ক্ষিপ্রগতির জাহাজগুলো নোঙর করলো, তখন কালিকটবাসী সাধারণ মানুষ আর সেখানে অবস্থানরত বণিকদের মাঝে দেখা দিলো প্রবল উত্তেজনা। এদেশের মানুষ আগে কখনও কামান দেখেনি। তাই আরব বণিকদের কাছে কামানের বৃত্তান্ত শুনেও ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারলো না যে আদৌ কামান অগ্নিগোলক বর্ষণ করে। কালিকটের রাজা জামোরিন এই কামানসজ্জা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও ভাস্কো দ্য গামাকে তিনি বন্দরে বাণিজ্য করার অনুমতি দিলেন। ভাস্কো দ্য গামা কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হন নি। তিনি অন্যায় দাবি উত্থাপন করে বসলেন, বন্দরের প্রচলিত শুল্কের দায় থেকে অব্যাহতি চাইলেন। মসলার যুদ্ধের গল্প শুরু এখান থেকেই।

কিন্তু এর প্রেক্ষাপট জানতে হলে ফিরে যেতে হবে আরও পেছনে, কারণ এর সাথে জড়িয়ে আছে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ইতিহাস। ক্রুসেডের আহবানে সারা ইউরোপময় প্রবল ধর্মোন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা – এই তিন মহাদেশেই মুসলমান ও খ্রিস্টানরা পরস্পর ঘোর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাই ইউরোপ আর এশিয়ার মাঝে অবস্থিত মিশর যখন মুসলমানদের অধিকারে চলে এলো, তখন খ্রিস্টান রাজ্যগুলো অসুবিধায় পড়ল। মিশর এড়িয়ে মসলার বাণিজ্যের কেন্দ্র ভারতবর্ষে পৌঁছানোর কোনো উপায়ই তাদের ছিল না। তাছাড়া আরব সাগর, লোহিত সাগর, পারস্য উপসাগর, ভারত মহাসাগর আর প্রশান্ত মহাসাগরে তখন আরব বণিকদের অবাধ বিচরণ তাদের মনে একটাই ভাবনা জাগিয়েছিল – যে করেই হোক ভারতবর্ষে পৌঁছানোর বিকল্প পথ আবিষ্কার করতেই হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলো জেনোয়া, আর নেতৃত্ব দিয়েছিলো পর্তুগাল।

পর্তুগালের রাজা ডোম হেনরি ভারতবর্ষে যাওয়ার বিকল্প পথ আবিষ্কারের জন্য দক্ষ গাণিতিক, মানচিত্রকারক, জ্যোতির্বেত্তা ও নাবিকদের একত্রিত করলেন, পর্তুগিজ জাহাজগুলোর গঠনে পরিবর্তন আনলেন। দূরদর্শী হেনরি নাবিকদের শিক্ষাদানের জন্য নৌ-বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। বহু বাধা-বিঘ্নের সম্মুখীন হয়ে, যাত্রাপথের দ্বীপগুলোয় স্থানীয় অধিবাসীদের হটিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করে পর্তুগিজ সাম্রাজ্যের বীজ বুনতে বুনতে একসময় সফল হল তারা। এ অভিযানে পোপ ৫ম নিকোলাসের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ১৪৫৪ সালে ভারতবর্ষ পর্যন্ত পর্তুগিজরারা যা কিছু আবিষ্কার করবে, তার ওপর একমাত্র অধিকার থাকবে রাজা হেনরির। হেনরির মৃত্যুর পর ১৪৮৭ সালে বার্থোলেমি ‘কেপ অব গুড হোপ’ আবিষ্কার করেন। অবশেষে ১৪৯৭ সালে ভাস্কো দ্য গামা কালিকটে পা রাখেন।

কালিকটে প্রাথমিক সফর শেষ করে ভাস্কো দ্য গামা দেশে ফিরে গেলেন। তার কাছে সব শুনে রাজা ডোম ম্যানুয়েল বুঝলেন ভারতবর্ষের মসলার বাণিজ্য করায়ত্ত করতে হলে আরব বণিকদের সাথে দীর্ঘ লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। তাই দ্বিতীয় অভিযানে তিনি পাঠালেন ৩৩ টি জাহাজ – পণ্যদ্রব্যের পরিবর্তে যাতে ছিলো ১৫০০ যোদ্ধা আর প্রচুর যুদ্ধসামগ্রী। এই অভিযানের নেতা ছিলেন পেড্রো আলভারেজ ক্যাব্রাল। এই বাহিনীর লক্ষ্য ছিল কালিকটরাজ জামোরিনের কাছ থেকে একটি বাণিজ্য ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি আদায় এবং পাঁচজন পাদ্রির মাধ্যমে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অনুমতি আদায়। আর জামোরিন এতে সম্মত না হলে একটাই করণীয় – আর তা হলো যুদ্ধের হুমকি। ক্যাব্রাল ৬ টি জাহাজ নিয়ে কালিকটের ঘাটে পৌঁছালেন, বাকি জাহাজগুলো রয়ে গেল জামোরিনের দৃষ্টিসীমার বাইরে। ক্যাব্রাল বাণিজ্য করার অনুমতি পেলেন। কিন্তু একসময় স্থানীয় লোকদের সাথে ঝামেলায় ক্যাব্রালের সহকারীসহ ৫০ জন নিহত হলে ক্যাব্রাল নগরের ওপর কামান দাগতে শুরু করেন। পর্তুগিজদের প্রতিহত করতে জামোরিন ১৫০০ যোদ্ধাসহ ৮০ টি জাহাজ পাঠান। এরপর ক্যাব্রাল কালিকট ছেড়ে সরে পড়েন। এরপরেই শুরু হয় পর্তুগিজদের বর্বরতা। রাজা ডোম ম্যানুয়েল নিজেকে ইথিওপিয়া, আরব, পারস্য ও ভারতের নৌ-চলাচল ও বাণিজ্যের প্রভু বলে ঘোষণা করেন। ভাস্কো দ্য গামা পর্তুগিজ বহর নিয়ে ভারত মহাসাগরে অবস্থান করেন। কোন রকম হুঁশিয়ারি ছাড়াই এই পথে আগত সব জাহাজ ও নৌ-বহর লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন।

মক্কা থেকে হজ্বযাত্রীদের কতগুলো নিরস্ত্র জাহাজ ফিরে আসছিলো- সেসব জাহাজের মালপত্র লুন্ঠণ করে হজ্বযাত্রীদের জাহাজে রেখেই জাহাজগুলোয় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় ভাস্কো দ্য গামারই নির্দেশে। হতভাগ্য আরবরা পুড়ে মরল। এই ধ্বংসযজ্ঞ ন্যায়সংগত কিনা – এর উত্তরে ঔপনিবেশিক শক্তিদের যুক্তি ছিল – সমুদ্রের বুকে নৌ-চলচলের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন এবং সকলের সম-অধিকার কেবল ইউরোপের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর পর্তুগিজরা সমুদ্রের প্রভু, তাই তাদের যেকোনো অনুমতি ছাড়া নৌচলাচল ন্যায়সংগত নয়!

পর্তুগাল সহ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো শোষণের নেশায় বিবেকবর্জিত হয়ে পড়েছিল। তারা খোলাখুলি ভাবেই স্বীকার করেছিল- আন্তর্জাতিক আইন কেবল সভ্য(!) ইউরোপীয়দের জন্যই প্রযোজ্য। ভাস্কো দ্য গামার বর্বরতার খবর শুনে কালিকটে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হল। সবার মনে পর্তুগিজদের প্রতি ক্ষোভ – ঘৃণা দানা বেঁধে উঠলো। কালিকটের হিন্দু – মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে একজোট হল। হিন্দু ও আরব বণিকদের এই ঐক্য শেষ দিন পর্যন্ত অটুট ছিলো। কালিকটের সবচেয়ে বড় আরব বণিক খোজা আম্বর রাজা জামোরিনকে তার সমস্ত নৌ-বহর দিয়ে সাহায্য করলেন। অবশেষে কোচিনের কাছে পর্তুগিজদের সাথে কালিকটের যুদ্ধ সংঘটিত হল। পর্তুগিজদের গোলার আঘাতে খোজা আম্বরের বড় বড় জাহাজগুলো অচল হয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু কালিকটের নৌ-সেনাপতি কাশিমের চাতূর্যে সেদিন রক্ষা পেল কালিকট, ভাস্কো দ্য গামা পরাজিত হয়ে ফিরে গেলেন নিজ দেশে। ভাস্কো দ্য গামা যেতে না যেতেই পর্তুগিজরা অতর্কিতে আবার হামলা চালালে জামোরিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি আরব বণিকদের পরামর্শ অনুযায়ী মিশরের সুলতানের সাহায্য চান। সুলতান দেড় হাজার যোদ্ধা দিয়ে জামোরিনকে সাহায্য করেন। সেনাপতি মীর হুসেন এ বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ১৫০৭ সালে কালিকট ও কোচিনের মাঝামাঝি চাওল নামক স্থানে মীর হুসেন ও জামোরিনের সম্মিলিত বাহিনী পর্তুগিজদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধে পর্তুগিজদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। এরপরেও পর্তুগিজরা পিছু হটে নি। তারা গুজরাট সুলতানের প্রতিনিধি দিউদ্বীপের শাসক মালিক আয়াজের বিশ্বাসঘাতকতাকে হাতিয়ার করে। তাই যুদ্ধে কোন মীমাংসা না হওয়া সত্ত্বেও মীর হুসেন সমস্ত জাহাজ নিয়ে দেশে ফিরে যান। মীর হুসেনের এই অদূরদর্শিতার জন্য মিশরকে অনুশোচনা করতে হয়েছিল। কারণ পর্তুগাল শুধু কালিকটের শত্রুই নয়, ছিল মিশরেরও শত্রু।

এরপর পর্তুগিজরা হয়ে উঠলো সমুদ্রের একচ্ছত্র অধিপতি, তাদের বাধা দেয়ার মত কেউ রইলো না। কিন্তু তারা কালিকট দখল করতে পারলো না। ১৫০৯-১৫৯০ এই ৯০ বছরের দুর্দম প্রতিরোধের পর ১৫৯৯ সালে কালিকটের সাথে পর্তুগিজদের সন্ধি স্থাপিত হল। কিন্তু মসলার বাণিজ্যে একচেটিয়া অধিকার পেয়ে গেলো পর্তুগিজরা। দেড়শ’ বছর ধরে এই মসলার বাণিজ্য পর্তুগিজদের করায়ত্তে ছিল। সন্ধি সত্ত্বেও পর্তুগিজরা চুপচাপ বসে থাকেনি। গ্র‍্যান্ডমার্শাল অব পর্তুগালের নেতৃত্বে ‘ফ্লিট অব পর্তুগাল’ আর শাসনকর্তা অ্যালবুকার্কের নেতৃত্বে ‘ফ্লিট অব ইন্ডিয়া’ অতর্কিতে হামলা চালালো। এবারো কালিকটের যোদ্ধাদের অপূর্ব রণকৌশলের কাছে হার মানতে হল তাদের। এটি ছিল পর্তুগিজদের সাথে কালিকটের প্রথম স্থলযুদ্ধ। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পর্তুগিজরা গোয়া দখল করল। এবার তারা দৃষ্টি ফেরালো ইন্দোনেশিয়ার দিকে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোতে প্রচুর মসলার চাষ হত। এ দ্বীপগুলোয় আধিপত্য বিস্তার করতে পারলে পর্তুগিজদের উদ্দেশ্য সফল হবে। তাই তারা সেসময়ে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপগুলোয় চলমান হিন্দু – মুসলিম দ্বন্দকে কাজে লাগিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করল। এরপর ১৫১১ খ্রিস্টাব্দে অতর্কিত হামলা হল মালাক্কা য়।বন্দরের কোনো জাহাজই এই আকস্মিক আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না।

অ্যালবুকার্কের নির্দেশে আরব বণিকদের ও ক্যাম্বের মুসলমান বণিকদের জাহাজগুলোয় আগুন লাগিয়ে দেয়া হল। কেউ কেউ জাহাজ থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে প্রাণ বাঁচালো। কিন্তু যারা তীরে উঠতে পারলো না, তাদের জলচর প্রাণীর মত শিকার করে হত্যা করা হল। এরপর যুদ্ধ করে নগর দখল করে নিল পর্তুগিজরা। আবার শুরু হল তাদের বর্বরতা। অধিকাংশ নগরবাসীকে হত্যা করা হল, যারা বেঁচে গেল- তাদের পণ্যের মত ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করা হল। এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য – পর্তুগিজরা নগরের চীনা, বর্মী ও হিন্দুদের হত্যা করেনি। দেশের একটা অংশকে হাতে রাখতেই তারা এই নীতি অনুসরণ করেছে। যেখানে যেখানে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ ছিল, সেখানেই তারা এই দ্বন্দের সুযোগ নিয়েছে। শুধু পর্তুগিজরাই নয়, পরবর্তীতে ডাচ ও ইংরেজরাও নিজেদের স্বার্থের জন্য ধর্মীয় দ্বন্দকে পুঁজি করেছে। এখানে এটা স্পষ্ট যে কালিকটে মুসলিম আর হিন্দুদের ঐক্য, অটুট বন্ধন ভাঙতে পারেনি বলেই পর্তুগিজদের পক্ষে কালিকট দখল করা সম্ভব হয় নি।

এইভাবে একসময় মসলার বাণিজ্য পর্তুগিজদের পূর্ণ দখলে চলে এলো। তুর্কির সুলতান সুলেমান পর্তুগিজদের প্রতিহত করতে চেয়েছিলেন। পরে একসময় তিনিও পিছিয়ে যান। কিন্তু প্রোটেস্টান্টবাদের উত্থান পর্তুগিজদের এই আধিপত্যে চিড় ধরালো। মার্টিন লুথার খ্রিস্টধর্মে নতুন ভাবধারা বয়ে আনলেন। প্রোটেস্টান্টরা ইউরোপে আলোড়ন সৃষ্টি করল। আগে পোপের নির্দেশ অনুযায়ী সমুদ্রসীমার অধিকার শুধু পর্তুগিজদেরই ছিল। কিন্তু এখন এই নির্দেশ শুধু রোমান ক্যাথলিকদের জন্যই প্রযোজ্য, প্রোটেস্টান্টরা এ আদেশ অমান্য করলো। পর্তুগাল ছাড়াও অন্যান্য খ্রিস্টান রাষ্ট্র ভারতবর্ষে যেতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখলো ডাচরা। তারা গঠন করলো ইউনাইটেড ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬০৪ সালে সম্রাট জামোরিনের সাথে সন্ধি করে ডাচরা পর্তুগিজদের বিতাড়িত করলো। তারা একে একে ইন্দোনেশিয়া, মালাক্কা, কলম্বো,কোচিনসহ আরো অসংখ্য ছোটখাটো বাণিজ্যকেন্দ্র দখল করল। পর্তুগিজদের হাতে দিউ আর দমন ছাড়া আর কোনো অঞ্চলই রইলো না।

পর্তুগিজদের হটিয়ে এবার ডাচরাও ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য গড়ার কাজে মন দিলো। পর্তুগিজরা শুধু উপমহাদেশের মসলা নিয়ে বাণিজ্য করতো। আর ডাচরা মসলার উৎপাদন শুরু করলো। ডাচ বণিকরা দাদনের সুযোগ নিয়ে চাষীদের জমি গ্রাস করে নিলো। ইংরেজ আমলে এই দাদনের জন্যই নীল চাষীরা সর্বস্বান্ত হয়েছিলো। চলতে লাগলো অবর্ণনীয় অত্যাচার, কৃষকরা শোষিত হতে লাগলো। যারা প্রতিবাদ করলো, তাদের উপর নেমে এলো অশেষ দুর্ভোগ। ডাচদের প্রথম জাহাজটি মোলাক্কাস থেকে যে লবঙ্গ বোঝাই করে নিয়ে গিয়েছিলো, সেই লবঙ্গ বিক্রি করে তাদের মুনাফা হয়েছিল ২৫ গুণ। ডাচরা কী পরিমাণ মুনাফা করছিলো এটাই তার প্রমাণ। এরপর তারা শুরু করল কফির চাষ। নিজেদের মুনাফার ভাণ্ডার পুর্ণ করতে তারা চাষীদের প্রবঞ্চিত করলো। তাদের কাছে ইন্দোনেশিয়ার চাষীরা সওয়া শ’ পাউন্ড কফির মূল্যে আড়াই শ’ পাউন্ড কফি বিক্রি করতে বাধ্য হত। নানারকম হিসেবের পর মাত্র চৌদ্দ পাউন্ড কফির দাম চাষীর ঘরে গিয়ে পৌঁছাত।

কেউ যে এই শোষকদের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ায় নি, তা নয়। কিন্তু তাদেরকে শোচনীয় পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। এরপর একসময় ইংরেজরাও আসে এ উপমহাদেশে, বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। তারাও উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার দিকেই এগোয়। ইংরেজদের শোষণের ইতিহাস সবার জানা। মসলার যুদ্ধ আসলে উপমহাদেশের মানুষের জন্য বড় একটা বার্তা বয়ে এনেছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ঐক্য আর দেশপ্রেম – এই তিনের অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, ততদিন কোনো সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের মাতৃভূমির সার্বভৌমত্বে আঘাত হানতে পারবেনা – কালিকট এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
মসলার যুদ্ধ – এক অন্ধকার অধ্যায়, একইসাথে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের জেগে ওঠার অসাধারণ উপাখ্যান। সব মিলিয়ে ইতিহাসের এক অনন্য সুন্দর অধ্যায় – মসলার যুদ্ধ!

লেখকঃ শিক্ষার্থী,আইআইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Comment